স্বরূপ আমার বন্ধু।
পাড়াতেই থাকে। পাড়ায় দেওয়াল পত্রিকা করার সূত্র ধরে ওর সাথে ঘনিষ্টতা এবং
বন্ধুত্ব। ওর হাত ধরেই নাটকের আঙ্গিনায় প্রবেশ। ছেলেটা বড় ভালো। ইমোশোনাল, গোঁয়ার,
সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত। দেখতে শুনতে সেরকম ভালো নয় তবে চালাক চতুর। সমস্যা
একটাই। মেয়েদের বড্ড ভয় পায়। আগ বাড়িয়ে কথা বলা তো দূর অস্ত যেখানে মেয়ে, ও তার
উল্টো দিকে। আমরা বন্ধু মহলে যখন মেয়ে নিয়ে নানারকম আলোচনায় ব্যস্ত, স্বরূপ তখন
ক্রমশ চলে যায় অন্য কোনো বিষয়ে। সিনেমার নায়িকাদের প্রতি তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।
বাঘা বাঘা সব নায়িকাদের সিনেমা তো দূর, সে তাদের ছবিও দেখেনি এখনও। মোদ্দা কথা হল,
আমরা সকলেই জানতাম, স্বরূপ মেয়েদের নিয়ে কোনোরকম কৌতুহল দেখায় না। মেয়েদের প্রতি
ওর রাগ ঘৃণা ভালোবাসা আগ্রহ কোনো কিছুই নেই।
একদিন দুজন মিলে
বইমেলায় যাচ্ছি। মাঝপথে হঠাৎ কি কথা প্রসঙ্গে স্বরূপ নিজের খোলস ছাড়াতে শুরু করে।
কথায় কথায় জানিয়ে দেয় তার আশেপাশের বাড়িতে যত মেয়ে রয়েছে প্রায় প্রত্যেকের সাথেই
তার কখনও না কখনও শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। শুধু মেয়ে নয়, আশে পাশের বাড়ির কিছু
বিবাহিত যুবতী মহিলার সাথেও তার অনেক গভীর সম্পর্ক। এই মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ আবার
আমাদের কোনো কমন ফ্রেন্ডের ঘোষিত বান্ধবী। কেউ কেউ আমাদের কোনো বন্ধুর বউ। কেউ
জানে না। কেউ না। আমার পায়ের তলা দিয়ে ক্রমশ মাটি সরে যাচ্ছে। এই কারণে নয় যে অনেক
নারীর সাথে তার শরীরের সম্পর্ক। এরকমটা তো অনেকেরই হয়ে থাকে। মাটি সরে যাচ্ছিল এই
ভেবে যে এতদিন আমরা বন্ধুরা কি ভয়ংকর মিথ্যের মধ্যে বাস করছিলাম। সেদিন সারাদিন
আমি স্বরূপের সাথে বইমেলাতে ঘুরলেও আমার মন কিন্তু সেই মাঝরাস্তা থেকেই বাড়ি ফিরে
এসেছিল।
তবে মিথ্যে সর্বদা এমন
ভয়ংকর নয়। কখনও মিথ্যে খুব সুন্দর। নতুন শাড়ি পরে বউ সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস
করল ‘কেমন লাগছে?’ বুকে হাত দিয়ে বলুন দেখি ক’টা পুরুষের ক্ষমতা আছে সত্যি কথা
বলার। আসলে প্রশ্নকর্তা নিজেও যে মিথ্যেটাই শুনতে চাইছে। ছোট শিশুকে বাবা ঘুম
পাড়িয়ে দিচ্ছে, বলছে ‘ঘুমিয়ে পড়, কাল তোমায় খেলনা কিনে দেব’। স্বামীর হাতে প্রচুর
মার খেয়েও মেয়ে তার মা-কে ফোনে বলছে ‘চিন্তা কোরো না, আমি ভালো আছি’। ক্যান্সারে
আক্রান্ত বাবা, বড়জোর দু-তিন মাস। ছেলে হাসপাতালে দেখা করতে এসে বলছে ‘আগামী বছর
তোমায় হরিদ্বার নিয়ে যাব’। বেশ করি মিথ্যে কথা বলি। কেন বলব না? যে মিথ্যে কারো
কোনো ক্ষতি করে না, সে মিথ্যে সত্যের থেকেও সুন্দর।
যে মিথ্যে কারো কোনো
ক্ষতি করে না!! কলেজ থেকে বেরিয়ে সাত্যকি ফোন করল লিপিকে। দু’বার। পরপর। দুবারেই
ফোন কেটে দিল। তার মানে সামনে কেউ আছে হয়ত। এরকম আগেও হয়েছে। সাথে মা থাকলে লিপি
ফোন কেটে দেয়। কিছুক্ষণ পর এসএমএস এলো ‘মায়ের সাথে পিসির বাড়ি বেরাতে এসেছি। রাতে
বাড়ি গিয়ে জানাবো। এর মধ্যে প্লীজ ফোন করবে না কিন্তু’। সাত্যকি প্রথমে খেলার মাঠে
যায়। সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পরে। রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখে দুটো এসএমএস।
প্রথমে লিপির এসএমএস টা পড়ে – ‘পিসির বাড়ি থেকে এই মাত্র ফিরলাম। খুব টায়ার্ড। কাল
সকালে ফোন করব। গুড নাইট।লাভ ইউ ফরএভার। মুহাআআআ’। দ্বিতীয় এসএমএস টা বিপ্লবের –
‘আজ সন্ধ্যেবেলায় লিপিকে দেখলাম, প্রিয়া সিনেমা হলে ইভিনিং শো দেখে বের হচ্ছিল,
সঙ্গে একটা হেব্বি ছেলে ছিল ভাই। তোর সাথে কি ব্রেক-আপ হয়ে গেছে নাকি’। ঠিক এর পর
সাত্যকি অনেক কিছু করতে পারে। আত্মহত্যা করতে পারে। হত্যা করতে পারে। পাগল হয়ে
যেতে পারে। মিথ্যের ক্ষমতা অনেক।
অফিসের ভানুদা হাতের
রুমাল মাথার উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে বলছে ‘জানো একবার কলেজ টুর্নামেন্টে আমাদের
৮ ওভারের মধ্যে ৭ উইকেট পড়ে গেছিল। ৯নম্বরে আমি নামলাম। সবাই এতদিন পাত্তা দিত না
আমায়। বাকি ১২ ওভারে তখন আমাদের দরকার ১৫৩। আমি আর প্রতাপ দুজন দুদিক সামলে ৩ বল
বাকী থাকতে সেই রান তুলে নিলাম। আমি করেছিলাম নট আউট ১২৭ মাত্র ৮০ বলে। আজ থেকে
ত্রিশ বছর আগের কথা বলছি। সেই সময় এইরকম মেরে খেলা কোথায় ছিল। আমাদের খেলা দেখতে
এসেছিলেন কপিল দেব। আমায় ডেকে নিয়ে বললেন ইন্ডিয়া টীমে আসুন।’ সেই বছরেই বাবা
হার্ট অ্যটাকটা হল। আমার আর যাওয়া হল না। অফিসের বাকিরা কিছুতেই হিসেব মিলিয়ে
পারলো না। প্রায় ৪৮ বছর বয়সী একজন মানুষ তার কলেজের টুর্নামেন্টে ভালো খেলে
ইন্ডিয়া টীমে যেতে পারলো না কারণ ১১ বছর আগে তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন
বলে? মিথ্যে বুঝেও অফিসের সকলে তাকে প্রশ্রয় দিলাম। বোরিং অফিস আওয়ার্সের কিছুটা সময়
এই যে ভানুবাবু রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে আর বাকি সকলে সেই রং-এ ডুবে যাচ্ছে এটা মন্দ কি।
মিথ্যে বলত ঘনাদা।
মিথ্যে বলত টেনিদা। রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন ‘জগতে
দুরকম পদার্থ আছে। এক হচ্ছে সত্য, আর হচ্ছে—আরও সত্য। আমার
কারবার আরও-সত্যকে
নিয়ে’। কি এই আরও সত্য সে আর কাউকে ব্যাখ্যা করে
বলে দিতে হবে না নিশ্চয়।
একটা মিথ্যে আমরা প্রায় প্রত্যেকে শুনেছি। শিয়ালদহ পার করেই ভীড় বাস ঠায়
দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। গন্তব্য হাওড়া। ভিড়ের মধ্যে কেউ চেঁচিয়ে ফোনে বলতে লাগলো
‘এই তো বাসে আছি। এসপ্লানেডে রয়েছি। দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছি।’ ফোনটা কেটে
লোকটি তার দিকে তাকিয়ে থাকা লোকদের একটু চোখ টিপে দিলেন। বাকি লোকেরাও মুচকি হেসে
তাকে সমর্থন করে বুঝিয়ে দিলেন এরকম তারাও করেছেন অনেকবার।
আকাশের দিকে তাকান। দেখুন সূর্য। স্থির। আমি যদি আপনাকে বলি, ‘সূর্য স্থির নয়,
পৃথিবী স্থির। সূর্য প্রতিদিন পূব থেকে পশ্চিমে তাকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে’। আপনি
আমায় নিশ্চয় পাগল ভাববেন। এবং এতটাই মুর্খ ভাববেন যে কোন রকম উত্তর না দিয়েই আমায়
এড়িয়ে যাবেন। আমি আপনাকে বলব পিছিয়ে যান। ২০০ / ৩০০ বছর পিছিয়ে যান। সে সময় যারা
বলেছিল ‘সূর্য স্থির নয়’ তারাই সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে সঠিক বলেছিল।
বিজ্ঞানের এক আবিষ্কারে সত্যের রূপ আজ পালটে গেছে। বুকে হাত দিয়ে কে বলতে পারবে আজ
থেকে ৩০০ বছর পর এরকম কিছু আবিষ্কার হবে না যেটা আমাদের এই সময়কার সত্যকে মাটিতে
আঁছড়ে ফেলবে।
ভাবুন তো সেই মানুষগুলোর কথা যাদের সামনে হঠাৎ চার্লস ডারুইন প্রমাণ করে দিলেন
মানুষের উৎপত্তি বানর থেকে। সত্য বলা কঠিন নয়, সত্যকে হজম করা কঠিন। যে সমাজ এখনও
সত্যকে সহজে হজম করতে শেখেনি সেখানে সত্য বলার আশা করাটাও অন্যায় বইকি। তাইতো
আমাদের এখনও বলতে হয় ‘ভারতীয় সংস্কৃতি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ’। ‘ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ
দেশ’। বলতে হয়, ‘এখানে নারীকে মাতা হিসেবে সম্মান করা হয়’। সর্বোপরি ‘ভারত একটি
গণতান্ত্রিক দেশ’। এরকম কত মিথ্যে প্রতিদিন আমাদের বলতে হয়। আমাদের বিশ্বাস করতে
হয়। করে থাকতে হয়। না থেকে উপায় বা কি!!!
এই যে মিথ্যেকে সত্য বলে বিশ্বাস করে মনে গেঁথে নেওয়া। এটাই হয়ত আশা। ‘একদিন
ঝড় থেমে যাবে / পৃথিবি আবার শান্ত হবে’। এই বিখ্যাত গানের লাইনটিকে আপনি কি বলবেন?
মিথ্যা?? নাকি আশা??
------- X -------
বিঃদ্রঃ এই লেখায় নেতা মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে তাদেরকে অকারণ
ব্যতিব্যস্ত করতে চাইনি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন